তাজমহল
ভারতের আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা মার্বেলের এই অমর সৌধটি বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর প্রেমের নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ১৬৩২ সালে এই স্থাপত্যকর্মের নির্মাণ কাজ শুরু করেন, যা সম্পূর্ণ হতে সময় নেয় প্রায় ২২ বছর। শুধু একটি সমাধিসৌধ নয়, তাজমহল হলো বিশ্ব ঐতিহ্যের এক জীবন্ত ইতিহাস, যেখানে প্রেম, শোক ও শিল্পের মেলবন্ধন ঘটেছে এক অনবদ্য সমন্বয়ে। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত এই স্থাপনাটি বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যেরও একটি, যা প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটককে আকর্ষণ করে।
![]() |
তাজমহল । Image by Nagesh Ramarao from Pixabay |
তাজমহলের সৌন্দর্য শুধু তার বাহ্যিক রূপেই সীমাবদ্ধ নয়, এর নির্মাণশৈলী ও স্থাপত্য কলার মধ্যেও লুকিয়ে আছে অসংখ্য বৈজ্ঞানিক রহস্য। পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় ও ইসলামিক স্থাপত্যের মিশেলে তৈরি এই সৌধে ব্যবহৃত হয়েছে রাজস্থানের মাকরানা থেকে আনা দুর্লভ শ্বেত পাথর, যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রঙের আভা ছড়ায়। প্রেমের এই প্রতীকটি কেবল একটি ঐতিহাসিক স্থান নয় বরং মানবসভ্যতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যা আমাদের শেখায় কিভাবে শিল্পের মাধ্যমে প্রেম ও আবেগকে চিরস্থায়ী রূপ দেওয়া যায়। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে নির্মিত এই স্থাপত্যকর্ম এখনও তার জৌলুস ও মহিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা প্রতিটি দর্শনার্থীর হৃদয়ে অম্লান ছাপ রেখে যায়।
তাজমহল সম্পর্কে প্রবন্ধ, কাহিনি, অনেক তথ্য ও রহস্য রয়েছে যেগুলো ইতিহাস, স্থাপত্য এবং সংস্কৃতির জগতে এক বিশাল গুরুত্ব বহন করে। এর গম্বুজ, মিনার, চাহার বাগ স্টাইলের বাগান এবং অলঙ্করণশৈলী একে করেছে অনন্য। তাজমহল কেন বিখ্যাত, কেন একে প্রেমের নিদর্শন বলা হয়, কিভাবে এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হলো, তাজমহলের অজানা তথ্য ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা আবিষ্কার করি ইতিহাস, ভালোবাসা ও শিল্পকলার এক চমৎকার সংমিশ্রণ। এই নিবন্ধে আমরা জানবো তাজমহল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য, যেমন- তাজমহলের গঠনশৈলী, এর নির্মাণের পেছনের কাহিনি, প্রেমের গল্প, নানা অজানা তথ্য এবং অন্যান্য বিষয়াবলী।
তাজমহলের ইতিহাস
তাজমহল নামটির মধ্যেই জড়িয়ে আছে অমর প্রেম, রাজকীয় গৌরব ও স্থাপত্যশিল্পের মহিমা। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন এই তাজমহল শুধু মুঘল সাম্রাজ্যের গর্ব নয় বরং এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আজকে যে তাজমহলকে আমরা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দেখি, সেটি আসলে এক বিশাল ইতিহাসের পরিণতি। তাজমহলের নির্মাণ শুরু হয় ১৬৩২ সালে, মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয় স্ত্রী মমতাজ মহল-এর স্মৃতিতে এই অপূর্ব সৌধ নির্মাণের আদেশ দেন। প্রায় ২২ বছর ধরে নির্মিত এই স্থাপনাটি শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। তাজমহলের নির্মাণে প্রায় ২০,০০০ কর্মী অংশ নিয়েছিলেন। তারা এসেছিলেন ভারত, পারস্য, তুরস্কসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। এটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছিল সাদা মার্বেল, যা রাজস্থানের মাকরানা অঞ্চল থেকে আনা হয়।
প্রেমের পটভূমি: শাহজাহান ও মমতাজ মহলের গল্প
তাজমহলের ইতিহাস শুরু হয় মুঘল সম্রাট শাহজাহান এবং তার প্রিয়তমা স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম (যিনি মমতাজ মহল নামে পরিচিত) এর অমর প্রেমকাহিনী থেকে। মুঘল ইতিহাসের পাতায় শাহজাহান ও মমতাজ মহলের প্রেমকাহিনী এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। শাহজাহান ও মমতাজ মহলের প্রেমকাহিনী ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী গল্পগুলোর একটি। ১৬০৭ সালে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে শাহজাদা খুররম (পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান) প্রথমবারের মতো বাজারে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন, সেখানে এক রুবি বিক্রেতার দোকানে ১৫ বছর বয়সী আরজুমান্দ বানু বেগম (পরবর্তীতে মমতাজ মহল) কে দেখে মুগ্ধ হন। সেই প্রথম দর্শনেই যুবরাজ খুররমের হৃদয়ে প্রেমের অঙ্কুর জন্ম নেয়। আরজুমান্দ ছিলেন পারস্য থেকে আগত অভিজাত আব্দুল হাসান আসাফ খানের কন্যা এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রধানমন্ত্রী মীর্জা গিয়াস বেগের নাতনী, যা তাকে রাজকীয় পরিবারের সাথে সংযুক্ত করেছিল। তাদের বাগদান হয় ১৬০৭ সালেই, কিন্তু জ্যোতিষশাস্ত্রের গণনা অনুযায়ী শুভ সময় না হওয়ায় বিয়ে পিছিয়ে যায় দীর্ঘ পাঁচ বছর। অবশেষে ১৬১২ সালের ১০ মে, তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার সময়কালে খুররম অন্য দুই বিবাহ করলেও (কান্দাহারি বেগম ও আকবরাবাদি মহলকে), তার হৃদয়ে আরজুমান্দই ছিলেন একমাত্র প্রিয়পাত্রী। ইতিহাসবিদের মতে মমতাজ মহল ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় স্ত্রী যদিও কিছু সূত্রে ভিন্নমত রয়েছে এবং তাঁকে দ্বিতীয় বা চতুর্থ স্ত্রী হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। মমতাজ মহল ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের সর্বাধিক প্রিয় এবং রাজকীয় মর্যাদাপ্রাপ্ত প্রধান স্ত্রী। বিয়ের পর সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে "মমতাজ মহল" (প্রাসাদের মুকুট) উপাধিতে ভূষিত করেন, যা তার অনন্য মর্যাদাকে নির্দেশ করে। তাদের প্রেমের গভীরতা বোঝা যায় এই ঘটনা থেকে যে, মমতাজ মহল ছিলেন শাহজাহানের একমাত্র স্ত্রী যাকে তিনি তার সমস্ত সামরিক অভিযানে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে যেতেন। এমনকি গর্ভাবস্থায়ও তিনি সম্রাটের সাথে সফর করতেন, যা মুঘল রীতি বিরুদ্ধ ছিল। ১৯ বছরের দাম্পত্যজীবনে মমতাজ ১৪টি সন্তানের জন্ম দেন, যার মধ্যে ৭ জনই বেঁচে ছিলেন। ১৬৩১ সালের ১৭ জুন, ডেক্কান অঞ্চলের (বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত) বুরহানপুর অভিযানের সময় মমতাজ মহল ১৪তম সন্তান গৌহারা বেগমের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মমতাজের মৃত্যুতে শাহজাহান গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। কথিত আছে যে, মমতাজ মৃত্যুর আগে তাকে তিনটি প্রতিশ্রুতি দিতে বলেছিলেন- তিনি যেন আর বিয়ে না করেন, তাদের সন্তানদের ভালভাবে লালন-পালন করেন এবং তার স্মৃতিতে একটি অনন্য স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। শাহজাহান এই তিনটি প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছিলেন, যার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা যায় তাজমহলের নির্মাণে। মমতাজের মৃত্যুর পর শাহজাহান প্রায় দুই বছর সকল সামাজিক অনুষ্ঠান বর্জন করেন, সাদা পোশাক পরিধান করতে শুরু করেন এবং সংগীত শোনা বন্ধ করে দেন। এই গভীর শোক ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তিনি নির্মাণ করেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমের নিদর্শন তাজমহল, যা আজও মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রেমের সবচেয়ে বড় প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত।
তাজমহল নির্মাণের সূচনা ও পরিকল্পনা
শাহজাহানের স্বপ্ন ছিল এমন একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা, যা শুধু তার স্ত্রীর স্মৃতিকে অমর করে রাখবে না বরং মুঘল স্থাপত্যের সর্বোচ্চ শৈল্পিক প্রকাশ ঘটাবে। তিনি চেয়েছিলেন এটি শুধু একটি সমাধি নয়, এক শিল্পকর্ম হোক, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষকে মোহিত করবে। ১৬৩২ সালে, তিনি মমতাজের স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে তাজমহল নির্মাণের কাজ শুরু করেন। তাজমহল নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে শাহজাহান নিযুক্ত করেন বিশ্বের সেরা স্থপতিদের। বলা হয়, প্রকল্পের প্রধান স্থপতি ছিলেন উস্তাদ আহমদ লাহৌরি, যিনি তৎকালীন মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম পথপ্রদর্শক ছিলেন। যদিও কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে পারস্যের স্থপতি ঈসা মুহাম্মদ এফেন্দিও এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। নির্মাণ স্থল হিসেবে আগ্রাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ এটি মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এবং যমুনা নদীর তীরবর্তী এই স্থানটি সম্রাটের প্রিয় ছিল।
তাজমহল নির্মাণ প্রক্রিয়া ও কারিগরী দক্ষতা
তাজমহল নির্মাণ প্রক্রিয়া ছিল এক দীর্ঘ ও অত্যন্ত জটিল প্রকল্প, যা শুরু হয় ১৬৩২ সালে এবং সম্পন্ন হয় প্রায় ২২ বছর পর, ১৬৫৩ সালে। এই দীর্ঘ নির্মাণকালে প্রায় ২০,০০০ শ্রমিক ও কারিগর কাজ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এই বিশাল কর্মীবাহিনীতে স্থপতি, রাজমিস্ত্রি, পাথর খোদাইকারী, ধাতুশিল্পী, চিত্রশিল্পী, ক্যালিগ্রাফার, গম্বুজ নির্মাতা এবং অন্যান্য দক্ষ শ্রমিকগণ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে ছিলেন প্রধান স্থপতি উস্তাদ আহমদ লাহৌরি, যিনি পারস্য এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলীকে একত্র করে তাজমহলের অনন্য নকশা তৈরি করেন।
তাজমহলের সাদা মার্বেল আনা হয়েছিল রাজস্থানের মাকরানা খনি থেকে, যা প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরত্ব থেকে হাতি, বলদ ও উটের পিঠে করে আনা হয়েছিল। শোনা যায়, এই পাথর পরিবহনে প্রায় ১০০০টি হাতী ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্যান্য মূল্যবান রত্ন ও পাথর, যেমন- লালপোরফাইরি রাশিয়া থেকে, নীলকান্তমণি শ্রীলঙ্কা থেকে, ফিরোজা তিব্বত থেকে, মালাকাইট বা পান্না ও কার্নেলিয়ান সৌদি আরব থেকে, ক্রিস্টাল চীন থেকে, ল্যাপিস লাজুলি আফগানিস্তান থেকে, প্রবাল ইতালি থেকে, জ্যাস্পার পাঞ্জাব থেকে এবং লাল আখিক, চুনী, রুবী ইত্যাদি মধ্য এশিয়া ও পারস্য অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হয়েছিল, যা ব্যবহার করা হয়েছিল সজ্জার জন্য।
তাজমহলের ভিত্তি নির্মাণে লাল বেলেপাথর আনা হয়েছিল দিল্লি ও ফতেহপুর সিক্রি থেকে। গভীর কূপ খনন করে কাঠ ও পাথরের শক্ত কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল, যেখানে জলপাই কাঠের রাফটার বা স্তম্ভ দিয়ে শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল, যা ভূমিকম্পের কম্পন শোষণে সহায়ক হয়। ভিত্তির উপরে পুরো স্মৃতিস্তম্ভটি একটি পাথরের প্ল্যাটফর্মে তৈরি যাতে বন্যার ঝুঁকি কমে। চারপাশের মিনারগুলো বাইরের দিকে সামান্য হেলে নির্মাণ করা হয়েছিল, যাতে ভূমিকম্প বা ধসের ক্ষেত্রে মূল সৌধ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এছাড়া, পুরো কাঠামো এমনভাবে পরিকল্পিত যে, এটি নিখুঁত সিমেট্রিতে দাঁড়িয়ে আছে, বাম ও ডান দিক একেবারে একইরকম। তাজমহলের দেয়াল নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছিল বিশেষ ধরনের মর্টার যা চুন, গুড়, ডিমের সাদা অংশ, গুঁড়া করা গুল্ম এবং অন্যান্য উপাদানের মিশ্রণে তৈরি করা হয়েছিল। এই বিশেষ মিশ্রণ পাথরগুলিকে এমনভাবে জোড়া দিয়েছিল যে আজও তা অটুট রয়েছে।
তাজমহলের দেয়াল অলঙ্করণে ফুল, লতা ও জ্যামিতিক নকশা তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়েছিল পিয়েত্রা ডুরা (Pietra Dura) নামে পরিচিত এক বিশেষ কৌশলে রত্ন বসিয়ে অলঙ্করণ করা হয়, যা ইতালীয় শিল্পীদের সহায়তায় করা হয়েছিল, এটি আজও অবাক করে বিশ্বের শিল্পপ্রেমীদের। কালো মার্বেলে সোনালি রঙে পবিত্র কুরআনের আয়াত খোদাই (ক্যালিগ্রাফি) করা হয়েছে, যা দূর থেকে সমান আকারের দেখাতে বিশেষ অপটিক্যাল টেকনিক ব্যবহার করা হয়েছিল।
তাজমহলের স্থাপত্য
তাজমহল কেবল একটি ভবন নয় বরং এটি একটি বিস্তৃত ও সুপরিকল্পিত স্থাপত্য কমপ্লেক্স, যাতে রয়েছে মূল সমাধি, একটি মসজিদ, একটি অতিথিশালা, প্রধান ফটক, চারটি মিনার এবং একটি সমান্তরাল চারবাগ বাগান। সম্পূর্ণ কমপ্লেক্সটি এমনভাবে পরিকল্পিত যে, এটি নিখুঁত জ্যামিতিক সিমেট্রি বজায় রেখে নির্মিত। তাজমহল বাগান, গেস্টহাউজ ও মসজিদ দিয়ে ঘেরা ১৭ হেক্টর জায়গা নিয়ে গঠিত এবং কমপ্লেক্সটির আকার ১৯০২ বাই ১০০২ ফুট। তাজমহলের স্থাপত্যশৈলী মূলত ইসলামিক স্থাপত্যশৈলী দ্বারা প্রভাবিত হলেও এতে পার্সিয়ান, তুর্কি ও ভারতীয় শৈল্পিক উপাদানের অপূর্ব সংমিশ্রণ রয়েছে। মূল গম্বুজটি “ডাবল-শেল গম্বু” নামে পরিচিত, যা এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তাজমহলের কেন্দ্রীয় গম্বুজটি ৭৩ মিটার (২৪০ ফুট) উঁচু এবং ১৮ মিটার (৬০ ফুট) চওড়া। এটি 'অমরুকা' শৈলীতে নির্মিত, যা মুঘল স্থাপত্যের একটি স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য। গম্বুজের চারদিকে চারটি মিনার রয়েছে, যার প্রতিটির প্রায় ৫০ মিটার (১৬২.৫ ফুট)। মিনারগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে বাইরের দিকে হেলানো, যাতে ভূমিকম্পের সময় এগুলো মূল সমাধির উপর না পড়ে। তাজমহলের কারুকার্য ও নকশাগুলো অভূতপূর্ব। এর অন্যান্য গম্বুজ ও মিনার, বাগান, জ্যামিতিক নকশা এবং পবিত্র কোরআনের আয়াত খচিত শিলালিপি, সবকিছুই নিখুঁত পরিকল্পনার ফসল। তাজমহলের দেয়ালে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ক্যালিগ্রাফি করে লেখা হয়েছে, মার্বেলের গায়ে আছে ফুল ও জ্যামিতিক ডিজাইন এবং বিভিন্ন ধরনের পাথর ও রত্নখচিত কারুকাজ, যা ইসলামী স্থাপত্যের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। তাজমহলের অলঙ্করণে ব্যবহৃত বহু রকমের জ্যামিতিক ও ফুলেল নকশা, যেগুলোর মধ্যে একটিও একরকম নয়। এটি প্রমাণ করে কেমন অসাধারণ মনোযোগ ও পরিশ্রম দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল পুরো স্থাপনাটি। তাজমহলের বাগানটি পার্সিয়ান চাহার বাগ ডিজাইনে করা, যার প্রতিটি দিক দিয়ে পানির ধারা বয়ে গেছে। যমুনা নদী থেকে পারস্য-অনুপ্রাণিত জলচক্র পদ্ধতিতে বাগানে পানি সরবরাহ করা হতো। বাগানটি ইসলামিক চেতনার জান্নাতের বাগান বা স্বর্গ উদ্যান ধারণার প্রতিফলন, যা একটি আদর্শ মুঘল চারবাগ পরিকল্পনা। তাজমহলের অভ্যন্তরভাগও ততোটাই অপূর্ব ও মনোমুগ্ধকর, যা প্রত্যেক দর্শনার্থীর মনে গেঁথে যায়। ভেতরে রয়েছে সম্রাট শাহজাহান ও মমতাজ মহলের প্রতীকী সমাধি। সমাধির চারপাশে শ্বেত মার্বেলের উপর নিখুঁতভাবে খোদাই করা জালিকাজ ও নান্দনিক পাথরের অলংকরণ অভ্যন্তরের সৌন্দর্যকে করে তুলেছে অতুলনীয়। বিশাল মার্বেল খণ্ডগুলোকে জোড়া না লাগিয়েই নিখুঁতভাবে কেটে এমন সূক্ষ্ম নকশা তৈরি করা হয়েছে, যা সত্যিই বিস্ময়কর। ভেতরের দেয়ালেও পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ক্যালিগ্রাফি করে লেখা হয়েছে। এই সৌধের অন্যতম বিস্ময় হলো এর রং পরিবর্তনের ক্ষমতা, এটি সকালে গোলাপি, দুপুরে উজ্জ্বল সাদা, সন্ধ্যায় সোনালি আর রাতে চাঁদের আলোয় রূপালি বা নীলাভ। তাজমহল এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যেখানে স্থাপত্য, প্রকৌশল, শৈল্পিকতা ও ধর্মীয় অনুপ্রেরণার এক পরিপূর্ণ সম্মিলন ঘটেছে। কারিগরী দিক থেকে, তাজমহল শুধু এক স্থাপত্য নয় বরং এক নিখুঁত পরিকল্পনা ও শৈল্পিকতার বিস্ময়। প্রতিটি দিক, প্রতিটি গম্বুজ ও খিলান, এমনকি প্রতিটি পাথরের পেছনে রয়েছে সূক্ষ্ম পরিমাপ ও ভারসাম্য। এই অসামান্য দক্ষতা এবং নির্ভুলতা তাজমহলকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত ও শিল্পের সমন্বয়ের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে স্থান করে দিয়েছে।
নির্মাণ ব্যয় ও অর্থনৈতিক প্রভাব
তাজমহল নির্মাণে আনুমানিক ব্যয় হয়েছিল ৩২ মিলিয়ন মুঘল রুপি, যা বর্তমান মূল্যে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ মুঘল রাজকোষ থেকে ব্যয় করা হয়েছিল, যা সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, এই বিশাল নির্মাণ প্রকল্প মুঘল রাজকোষকে এমনভাবে সঙ্কুচিত করেছিল যে এটি পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের পতনের একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে অন্য ইতিহাসবিদরা এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন, যুক্তি দেখান যে মুঘল সাম্রাজ্য তখনও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ছিল।
সমাপ্তি ও পরবর্তী ইতিহাস
১৬৪৩ সালের দিকে মূল সমাধিটি সম্পূর্ণ হয়েছিল, তবে পুরো চত্বরসহ সমগ্র কমপ্লেক্সের কাজ শেষ হতে ১৬৫৩ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছিল। দুঃখের বিষয়, সম্রাট শাহজাহান তার এই মহান সৃষ্টি উপভোগ করতে পারেননি বেশিদিন। ১৬৫৮ সালে, তার পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আগ্রা ফোর্টে বন্দী করে রাখেন। শাহজাহান তার জীবনের শেষ আট বছর আগ্রা ফোর্টের মুসাম্মান বুরুজ থেকে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছিলেন। ১৬৬৬ সালে শাহজাহান মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে মমতাজ মহলের পাশেই সমাহিত করা হয়, যা তাজমহলের মূল নকশার অংশ ছিল না কিন্তু পরবর্তীতে যোগ করা হয়েছিল।
তাজমহলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সংরক্ষণ
মুঘল স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শনগুলোর মধ্যে তাজমহল সবচেয়ে খ্যাতিমান ও বহুল আলোচিত। যদিও হুমায়ুনের সমাধি, লাল কেল্লা, সিকান্দরা, আগ্রা ফোর্ট ও ফতেপুর সিক্রির মতো স্থাপনাগুলোও ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তবুও প্রেমের প্রতীক, নির্মাণশৈলীর নিখুঁত সৌন্দর্য এবং সূক্ষ্ম অলংকরণে তাজমহল একেবারেই অতুলনীয়। তাজমহল মুঘল আমলের স্থাপত্যশিল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তাজমহলের ইতিহাস কেবল মুঘল যুগেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগ, স্বাধীন ভারতের শিল্প-সংস্কৃতি এবং আধুনিক পর্যটন অর্থনীতির সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের সময়, ব্রিটিশ সৈন্যরা তাজমহলের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এবং মূল্যবান পাথর ও ধাতু লুট করেছিল। ১৯ শতকের শেষের দিকে, লর্ড কার্জন তাজমহলের ব্যাপক সংস্কার কাজ শুরু করেন, যা এই স্থাপত্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। ১৯৮৩ সালে তাজমহলকে UNESCO World Heritage Site ঘোষণা করা হয়। তাজমহল বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে স্বগর্বে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে এবং এটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পর্যটক আকৃষ্টকারী স্থাপত্যগুলোর একটি। কিন্তু বর্তমানে পরিবেশ দূষণ, বৃষ্টি, পর্যটকের চাপ ইত্যাদি নানা কারণে তাজমহলের মার্বেল সাদা রং ধীরে ধীরে হলুদাভ হয়ে যাচ্ছে। তাজমহল সংরক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারত সরকার ‘তাজ প্রকল্প’ নামে একটি সংরক্ষণ পরিকল্পনা চালু করেছে, যার মূল লক্ষ্য তাজমহলকে দূষণ ও সময়ের ক্ষয় থেকে রক্ষা করা, যাতে এর গঠন ও নান্দনিকতা অক্ষুণ্ণ রাখা যায়।
তাজমহলের পেছনের কাহিনি ও লোককথা
তাজমহল ঘিরে রয়েছে অনেক লোককথা ও কিংবদন্তি, যেগুলোর কিছু বাস্তবতার কাছাকাছি হলেও অনেকটাই রয়ে গেছে রোমান্টিক কল্পনায় মোড়ানো। একটি প্রচলিত লোককথা অনুসারে, শাহজাহান নাকি তাজমহল নির্মাণের পর স্থপতিদের হাত কেটে ফেলেন যাতে তারা আর কখনো এমন অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি না করতে পারেন। যদিও ইতিহাসবিদদের মতে, এই গল্পটি সত্য নয় বরং একটি কাল্পনিক কাহিনি। তবুও এটি বহু মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। আরও একটি প্রচলিত কথা হলো, শাহজাহান চেয়েছিলেন তাজমহলের মতো আরেকটি কালো রঙের সৌধ যমুনা নদীর অপর পাশে তৈরি করতে, যেখানে তিনি নিজের সমাধি রাখবেন। কিন্তু তার পুত্র আওরঙ্গজেবের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়াও, তাজমহলের গম্বুজের নিচে মমতাজ মহলের সমাধিতে একটি রহস্যময় আলো জ্বলে, যা কেবল বিশুদ্ধ হৃদয়ের মানুষরাই দেখতে পায় এবং তাজমহলের নিচে গোপন সুড়ঙ্গ আছে যেখানে রাজপরিবারের গুপ্তধন লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এইসব কাহিনি তাজমহলের সৌন্দর্যকে যেমন রহস্যময় করে তোলে, তেমনি এটিকে ঘিরে মানুষের আগ্রহ ও বিস্ময় আরও বাড়িয়ে তোলে। এই সব গল্প ও বিশ্বাস তাজমহলকে শুধু একটি স্থাপত্য নয়, একটি প্রেম ও রহস্যের প্রতীকে পরিণত করেছে।
তাজমহলের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
তাজমহল শুধু একটি প্রেমের স্মৃতিস্তম্ভ নয়, এটি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকও বটে। মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনকালকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তাজমহল একটি শক্তিশালী নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি মুঘলদের প্রশাসনিক ক্ষমতা, সমৃদ্ধি ও স্থাপত্যকলার উৎকর্ষের প্রতিফলন। শাহজাহানের রাজত্বকে অনেকেই মুঘল স্থাপত্যের ‘গোল্ডেন এজ’ বলেন, যেখানে তাজমহল ছিল চূড়ান্ত নিদর্শন। আজও এটি ভারতের জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম গৌরব এবং বিশ্ব সংস্কৃতির অমূল্য রত্ন। শাহজাহান তাজমহলের মাধ্যমে শুধু তাঁর ব্যক্তিগত শোক প্রকাশ করেননি বরং একটি সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক শক্তি ও ঐতিহাসিক পরিচয় তুলে ধরেছেন। এই সৌধের মাধ্যমে মুঘল শাসকদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও সাম্রাজ্যিক গৌরব আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এমনকি ব্রিটিশ শাসনামলেও তাজমহল ভারতীয় ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা উপনিবেশিক প্রশাসনকে ভারতের ঐতিহ্যগত গৌরবের সঙ্গে যুক্ত রাখতে সাহায্য করেছিল।
সাংস্কৃতিক দিক থেকে তাজমহল যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী শান্তি, সৌন্দর্য, প্রেম ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। ইসলামী, পারস্য, তুর্কি এবং ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে নির্মিত এই সৌধটি ভারতীয় সংস্কৃতির একটি চিরন্তন পরিচয়। তাজমহলের সৌন্দর্য ও স্থাপত্যশৈলী বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছে। এটি ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাজমহল শুধু একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতির এক অমূল্য রত্ন। তাজমহলকে কেন্দ্র করে সংগীত, কবিতা, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র এবং সাহিত্যকর্মে অসংখ্য অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়েছে, যা ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরেছে। এটি বিশ্ববাসীর চোখে ভারতের এক অসাধারণ পরিচয় বহন করে। তাজমহল ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যা এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি করে। এটি আজ ভারতের পর্যটন শিল্পের প্রধান কেন্দ্রস্থল, যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৭০-৮০ লক্ষ দেশি ও বিদেশি পর্যটক এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে আগ্রহী হয়ে ভারতের আগ্রা ভ্রমণ করেন। তাজমহল এখন শুধু একটি স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন নয় বরং এটি এক বিশ্বজনীন সাংস্কৃতিক প্রতীক, যা প্রেম, শোক এবং শিল্পকলার এক চিরন্তন উপাখ্যান বহন করে। আধুনিক ভারতের জাতীয় পরিচয় ও ঐতিহ্যগত অহংকারের প্রতিচ্ছবি হিসেবে তাজমহল আজ বিশ্বব্যাপী সম্মানিত, যা ভারতের অতীত, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
তবে, তাজমহলকে ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্কও কম নেই, কিছু গোষ্ঠী ও ঐতিহাসিকরা দাবি করেন যে তাজমহল আসলে একটি প্রাচীন শিব মন্দির ছিল, যা মুঘল সম্রাট শাহজাহান দখল করে তার প্রিয় স্ত্রী মমতাজ মহলের সমাধিতে রূপান্তরিত করেন। এই দাবির পক্ষে তারা বেশ কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করেন, যেমন- তাজমহলের স্থাপত্যে হিন্দু মন্দিরের মতো কিছু নকশা থাকা, ভূগর্ভস্থ কক্ষে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি বা প্রতীক থাকার গুজব এবং কিছু প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থে "তেজো মহালয়" নামে একটি স্থানের উল্লেখ থাকা। এই তত্ত্ব প্রথম জনপ্রিয়তা পায় লেখক পুরাতত্ত্ববিদ পি.এন. ওক-এর লেখালেখির মাধ্যমে, যিনি তাঁর বইয়ে দাবি করেন যে তাজমহলের স্থাপত্য ও নাম হিন্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলে যায় এবং এটি মূলত হিন্দু ধর্মীয় স্থাপনা ছিল। এই দাবির সমর্থনে ১৯৮৯ সালে এক আইনি মামলাও দায়ের করা হয়েছিল, যেখানে তাজমহলকে হিন্দু মন্দির হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আবেদন জানানো হয়। যদিও এই দাবিগুলোর পেছনে কিছু প্রতীক ও স্থাপত্য উপাদানের ওপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, ভারত সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ (ASI) ও মূলধারার ইতিহাসবিদরা এই দাবিকে ভিত্তিহীন ও ঐতিহাসিক প্রমাণবিহীন বলে অভিহিত করেছেন। প্রামাণিক ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় তাজমহলকে হিন্দু মন্দির বলে প্রমাণিত করার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। মুঘল দলিলপত্র, ইউরোপীয় পর্যটকদের বিবরণ এবং সমকালীন শিলালিপি থেকে স্পষ্ট যে তাজমহল ১৭শ শতকে শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত একটি ইসলামিক সমাধিসৌধ। এছাড়াও, তাজমহলের ডিজাইন ও নকশায় পারস্য ও ইসলামিক স্থাপত্যের প্রভাব স্পষ্ট, যা হিন্দু মন্দিরের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই বিতর্ক তৈরি হলেও, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণায় তাজমহলের নির্মাণ ইতিহাস নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে, এই বিতর্ক ভারতে ধর্মীয় জাতিগত বিভেদের একটি সংবেদনশীল ইস্যু হিসেবে রয়ে গেছে।
তাজমহল সম্পর্কে অজানা তথ্য
তাজমহল সম্পর্কে কিছু অজানা ও চমকপ্রদ তথ্য নিচে দেওয়া হলো:
- তাজমহলের প্রোটোটাইপ: তাজমহল নির্মাণের পূর্বে এর সম্পূর্ণ কাঠামোর একটি বৃহৎ কাঠের মডেল প্রস্তুত করা হয়, যা মূল নকশা যাচাই ও বাস্তব প্রয়োগের পূর্বপর্যায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই মডেলের মাধ্যমে স্থপতিরা স্থাপত্যের গঠনগত ভারসাম্য, নকশার সুনির্দিষ্ট উপাদান এবং আলো ও ছায়ার প্রভাব বিশ্লেষণ করেন। এটি নির্মাণশৈলীর যথার্থতা নিশ্চিত করতে এবং সম্ভাব্য ত্রুটি পূর্বেই চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই কাঠের মডেলটি ছিল একটি ত্রিমাত্রিক পরিকল্পনার প্রাচীন রূপ, যার মাধ্যমে তৎকালীন প্রকৌশলীরা ও রাজপরিবারের সদস্যরা নির্মাণ-পরবর্তী তাজমহলের চূড়ান্ত রূপ কল্পনা করতে পারতেন। এটি শুধুমাত্র নকশার উপস্থাপনাই নয় বরং একটি কার্যকর যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল, যা থেকে স্পষ্ট হয় যে তাজমহলের মতো জটিল স্থাপত্য নির্মাণে কতটা অগ্রসর ও সূক্ষ্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল।
- তাজমহল একক কাঠামো নয়: তাজমহল শুধু একটি ভবন নয়, এটি একটি সুপরিকল্পিত স্থাপত্য কমপ্লেক্স, যার প্রতিটি অংশ নিখুঁত ভারসাম্যে নির্মিত। এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মূল সমাধি ভবন, একটি মসজিদ, একটি অতিথিশালা, বিশাল প্রবেশদ্বার এবং চারদিকের সুউচ্চ মিনার। সেই সঙ্গে রয়েছে আকর্ষণীয় জলফোয়ারা ও সুসজ্জিত চতুষ্কোণ বাগান, যা মুঘল বাগানশৈলীর নিদর্শন। পুরো কমপ্লেক্সটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যে এটি জ্যামিতিক সিমেট্রির এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।
- তাজমহলের নিচে গুপ্ত কক্ষ: তাজমহলের মূল সমাধির নিচে আরও কিছু অজানা কক্ষ রয়েছে, যা সাধারণত দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ থাকে। কিছু ঐতিহাসিক ধারণা করেন যে, সেখানে শাহজাহান বা মমতাজ মহলের সাথে সম্পর্কিত আরও কিছু গোপন নিদর্শন থাকতে পারে।
- তাজমহল নির্মাণে কোনো সিমেন্ট ব্যবহার হয়নি: এটি তৈরি হয়েছে মার্বেল, চুন, গুড়, ডিমের সাদা অংশ, গুঁড়া করা গুল্ম ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে। সময়ের পরেও এর স্থায়িত্ব প্রমাণ করছে সেই দক্ষ নির্মাণশৈলী।
- মিনারগুলো আসলে সামান্য বাইরে হেলানো: তাজমহলের চারটি মিনার একটু একটু করে বাইরে দিকে হেলানো। এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে, যাতে ভূমিকম্প বা অন্য কোনো দুর্যোগে মিনারগুলো ভেঙে পড়লেও মূল সমাধির ওপর না পড়ে।
- শাহজাহানের নিজের কবর ছিল পরিকল্পনার অংশ নয়: তাজমহলের মূল সমাধির কেন্দ্রে শুধুমাত্র মমতাজ মহলের কবর থাকার কথা ছিল। পরবর্তীতে শাহজাহানকেও সেখানে সমাহিত করা হয়, তবে তাঁর কবরটি একপাশে সরিয়ে রাখা হয়, তাতে স্থাপত্যের প্রতিসাম্যতা নষ্ট হয়েছে।
- তাজমহলের উপরে লেখা কুরআনের আয়াত: তাজমহলের গম্বুজ ও দরজায় ক্যালিগ্রাফি আকারে কুরআনের আয়াত লেখা আছে। বিশেষত, সূরা ইয়াসিন (মৃতদের জন্য প্রার্থনা সংবলিত) মমতাজের সমাধির ওপর খোদাই করা।
- তাজমহলের রং পরিবর্তন হয়: তাজমহল দিনের আলোর ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন রঙে দৃশ্যমান হয়। সকালে এটি হালকা গোলাপি, দুপুরে উজ্জ্বল সাদা, সন্ধ্যায় সোনালি আর চাঁদের আলোয় রুপালি বা নীলাভ দেখায়। এটি আলোর প্রতিফলন ও পরিবেশের কারণে হয়। এটি শুধু সৌন্দর্যের বিষয় নয়, প্রকৃত অর্থেই প্রেম ও বেদনার প্রতীক হিসেবে এর আবেগঘন রূপ প্রতিফলিত করে।
- দ্বিতীয় তাজমহলের পরিকল্পনা: কিছু ইতিহাসবিদের মতে, শাহজাহান যমুনা নদীর অপর পাশে একটি কালো তাজমহল তৈরি করতে চেয়েছিলেন নিজের জন্য, যাতে দুটো সৌধ একটি সেতু দিয়ে যুক্ত থাকে। কিন্তু পুত্র আওরঙ্গজেব তাকে সিংহাসনচ্যুত করার পর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
- চিরস্থায়ী প্রেমের গল্পের আড়ালে নিষ্ঠুরতা: একটি জনশ্রুতি আছে যে শাহজাহান তাজমহলের নকশাকারী উস্তাদ আহমদ লাহোরির হাত কাটার আদেশ দিয়েছিলেন যাতে তিনি আর কখনো এমন স্থাপনা তৈরি করতে না পারেন। তবে ইতিহাসবিদরা এটিকে গল্প বলে উড়িয়ে দেন।
- সমাধি আসল নয়: পর্যটকরা যে সমাধি দেখেন, সেটি আসলে নকল সমাধি। আসল সমাধি নিচের একটি গোপন কক্ষে রয়েছে, ইসলামিক রীতি অনুযায়ী সমাধি সরল ও গম্ভীর রাখা হয়।
- বিশ্বের প্রথম সপ্তাশ্চর্যের তালিকায়: ২০০৭ সালে তাজমহল "নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড"-এর তালিকায় স্থান পায়, যেখানে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ভোট দিয়েছিলেন।
- ব্রিটিশ রাজের সময় ক্ষতি: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা তাজমহলের মূল্যবান পাথর ও সোনা লুট করে এবং কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরবর্তীতে লর্ড কার্জন মেরামতের ব্যবস্থা করেন।
- যুদ্ধের সময় ছদ্মবেশ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমারু বিমানের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাজমহলের উপরে বাঁশের খাঁচা তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বিমান হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য সবুজ আবরণ ব্যবহার করা হয়েছিল।
- পরিচর্চা: তাজমহলের শুভ্র মার্বেল পাথর আগ্রার বায়ু দূষণ, ধুলোবালি ও জলবায়ুর প্রভাবে হলদেটে হয়ে যেতে থাকে। এই দাগ ও বিবর্ণতা দূর করে মূল রঙ ও জৌলুস ফিরিয়ে আনার জন্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (ASI) বেশ কয়েক দফায় মুলতানি মাটি ব্যবহার করে এর সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনে।
তাজমহল ভ্রমণ গাইড
- তাজমহল কোথায় অবস্থিত: তাজমহল ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আগ্রা শহরে অবস্থিত। এটি যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত একটি বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। আগ্রা দিল্লি থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সময় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল।
- যাওয়ার উপায়: ট্রেনে দিল্লি থেকে আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে শতাব্দী এক্সপ্রেস বা গতিমান এক্সপ্রেসে প্রায় ২-৩ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়। সড়কপথে দিল্লি থেকে আগ্রা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি বা বাসে প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগে। বিমানে আগ্রার কাছে খেরিয়া বিমানবন্দর রয়েছে, তবে সাধারণত দিল্লি বা জয়পুর থেকে ট্রেন বা রোডে যাওয়াই সুবিধাজনক।
- টিকেটের দাম: বর্তমানে তাজমহল কমপ্লেক্সে প্রবেশের জন্য ভারতীয়দের ৫০ রুপি এবং বিদেশিদের ১১০০ রুপি (পরিবর্তনশীল)। অনলাইনে অগ্রিম টিকেট ক্রয়ের সুযোগ রয়েছে। তবে, মূল সমাধির ভেতরে প্রবেশের জন্য অতিরিক্ত ২০০ রুপি প্রযোজ্য, এই টিকেট প্রথম কাউন্টার বা তাজমহল কমপ্লেক্সের প্রবেশের পরেও ক্রয় করা যাবে।
- সিকিউরিটি: তাজমহলে প্রবেশের আগে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ব্যাগ বা বোতলজাত দ্রব্য, নেশাজাত সামগ্রী, ধূমপান উপকরণ ও লাইটারসহ যেকোনো নিষিদ্ধ বস্তু বহন করা নিষেধ।
- তাজমহল দেখার সেরা সময়: অক্টোবর থেকে মার্চ (শীতকাল), যখন আবহাওয়া আরামদায়ক।
- খোলার সময়: তাজমহল সাধারণত প্রতিদিন সকাল ৬:০০টা থেকে বিকাল ৬:৫০ পর্যন্ত খোলা থাকে।
- তাজমহল রাতে খোলা হয় কি: সাধারণত না, তবে পূর্ণিমার রাতে বিশেষ ট্যুরে অনুমতি দেওয়া হয়।
- ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি: মোবাইল ও ডিএসএলআর দিয়ে ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি অনুমোদিত, তবে ড্রোন ও ট্রাইপড সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। মূল সমাধির ভিতরেও ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
- বন্ধের দিন: শুক্রবার
উপসংহার
তাজমহল শুধু একটি রাজকীয় সমাধি নয়, এটি ভালোবাসার এক অমর কাব্য, ইতিহাসের পাতায় লেখা এক নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা। শাহজাহানের মুমতাজ মহলের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে গড়ে ওঠা এই স্থাপত্যশিল্প আজও প্রেমের সর্বোচ্চ প্রতীক হিসেবে সমাদৃত। মুঘল স্থাপত্যের অসাধারণ সব নিদর্শনের মধ্যে, যেমন- হুমায়ুনের সমাধি, আগ্রা ফোর্ট, রেড ফোর্ট বা ফতেহপুর সিক্রি রয়েছে, তেমনই তাজমহল তার অনন্য নির্মাণশৈলী, সিমেট্রিকাল ডিজাইন, সুচারু অলংকরণ এবং সুউচ্চ গম্বুজের জন্য বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় হয়ে উঠেছে। প্রায় ২২ বছর ধরে উস্তাদ আহমদ লাহৌরি-সহ হাজার হাজার শিল্পীর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে ওঠা এই স্থাপত্য মহাকাব্য মুঘল শিল্পকলার চূড়ান্ত প্রকাশ। সাদা মার্বেলের গম্বুজ, জটিল ফুলেল নকশা, প্রতিফলিত জলাধার এবং সুশোভিত বাগান, সব মিলিয়ে তাজমহল যেন স্বর্গের একটি অংশকে মর্ত্যে নামিয়ে এনেছে। এটি কেবল ভারতের উত্তরপ্রদেশের আগ্রায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক নিদর্শনই নয় বরং ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের এক গর্বিত প্রতীক, যা মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলোর মধ্যে অন্যতম।
তাজমহলের রহস্য ও সৌন্দর্য আজও গবেষক ও পর্যটকদের বিস্ময়ের অন্ত রাখে না। দিনের বিভিন্ন সময়ে সূর্যের আলোয় এর রঙের পরিবর্তন, রাতে চাঁদের আলোয় এর মায়াবী আবির্ভাব এবং ভেতরের অলংকৃত সমাধিকক্ষ, সবই এই স্থাপত্যের জাদুকে আরও গভীর করে তোলে। প্রধান স্থপতি উস্তাদ আহমদ লাহোরির নিপুণ পরিকল্পনা এবং শিল্পবোধ তাজমহলকে শিল্পের এক জীবন্ত পাঠশালায় পরিণত করেছে। আজও এটি শুধু অতীতের স্মৃতিচিহ্ন নয় বরং প্রেম, নিষ্ঠা ও স্থাপত্য শিল্পের এক অবিনশ্বর দলিল। তাজমহল আমাদের শেখায় যে প্রকৃত ভালোবাসা ও সৃজনশীলতা কীভাবে কালজয়ী হয়ে উঠতে পারে। এটি শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে, এক অনন্ত প্রেমের নীরব সাক্ষী হিসেবে।
তাজমহল প্রেমের এমন এক নিঃশব্দ উচ্চারণ, যা পাথরে পাথরে জড়িয়ে রেখেছে অমর ভালোবাসার গল্প। শাহজাহান যখন হারালেন তাঁর জীবনের আলোকশিখা মমতাজ মহলকে, তখন সেই হৃদয়ভাঙা যন্ত্রণা থেকে জন্ম নিল এক চিরন্তন স্মৃতিচিহ্ন। তাজমহল শুধুই এক সমাধি নয়, এটি প্রেমের রূপক, যেখানে প্রতিটি খোদাই, প্রতিটি গম্বুজ আর প্রতিটি জ্যামিতিক নিদর্শন বলছে একটাই কথা, সত্যিকারের ভালোবাসা সময়ের সীমা ছাড়িয়ে চিরকাল বেঁচে থাকে। মমতাজের প্রতি শাহজাহানের ভালোবাসা যেন নিঃশব্দে ফিসফিস করে যায় শ্বেত মার্বেলের বুক ছুঁয়ে- তুমি হারিয়ে যাওনি, তুমি আছো এই অনন্ত সৌন্দর্যে। তাজমহলের সৌন্দর্য এমন এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। যারা এটি দেখেছেন, তারা জানেন এর মহিমা। আর যারা দেখেননি, তারা রয়ে গেছেন এক অপূর্ণতায়। তাই বলা যায়, তাজমহল দেখা মানে যেন জীবনের এক নতুন অধ্যায় উন্মোচন করা।
“এই দুনিয়ায় দুই দলের মানুষ আছে, এক দল তাজমহল দেখেছে আর অন্য দল তাজমহল দ্যাখেনি!”
সচরাচর প্রশ্ন
প্রশ্ন: তাজমহল কে নির্মাণ করেন?
উত্তর: তাজমহল নির্মাণ করেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। ১৬৩২ সালে তিনি তার প্রিয় স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে এই বিশ্ববিখ্যাত সৌধটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। প্রায় ২০,০০০ শ্রমিক ও শিল্পী ২২ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৬৫৩ সালে তাজমহলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে। সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি এই স্থাপত্য শিল্পের অনন্য নিদর্শন আজ বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসেবে স্বীকৃত।
প্রশ্ন: তাজমহলের প্রধান স্থপতি কে?
উত্তর: তাজমহলের প্রধান স্থপতি ছিলেন উস্তাদ আহমদ লাহোরি। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের একজন বিখ্যাত স্থপতি ছিলেন এবং তার অসাধারণ নকশা ও নির্মাণ দক্ষতায় তাজমহল বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর স্থাপনাগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠেছে। উস্তাদ আহমদ লাহোরির নেতৃত্বে বিশাল এক দল শিল্পী ও কারিগর তাজমহলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছিলেন, যা আজও স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত।
প্রশ্ন: তাজমহল কত বছর ধরে তৈরি হয়েছিল?
উত্তর: তাজমহল নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৩২ সালে এবং সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে প্রায় ২২ বছর। মূল সমাধি নির্মাণ শেষ হয় ১৬৪৩ সালের মধ্যে, তবে চারপাশের বাগান, মিনার ও অন্যান্য কাঠামোর কাজ চলে ১৬৫৩ সাল পর্যন্ত। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই নির্মাণ প্রক্রিয়া একে করে তোলে স্থাপত্যশিল্পের এক বিস্ময়কর নিদর্শন।
প্রশ্ন: তাজমহল কোন রাজ্যে অবস্থিত?
উত্তর: তাজমহল ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত। এটি আগ্রা শহরের যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত, যা উত্তর ভারতের একটি ঐতিহাসিক ও পর্যটনসমৃদ্ধ শহর। এই রাজ্যেই রয়েছে মোগল স্থাপত্যের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
প্রশ্ন: তাজমহলের রং পরিবর্তন হয় কেন?
উত্তর: তাজমহলের রং পরিবর্তন হয় সূর্যের আলোর ভিন্নতার কারণে। দিনের বিভিন্ন সময়ে মার্বেল পাথরে আলোর প্রতিফলন ভিন্ন রূপ নেয়, ভোরের আলোয় গোলাপি, দুপুরে ঝকঝকে সাদা, সন্ধ্যায় সোনালি আর চাঁদের আলোয় রুপালি বা নীলাভ আভা দেখা যায়। এই অপূর্ব দৃশ্য তৈরি হয় সূর্যকিরণের কোণ ও বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থার পরিবর্তনের ফলে, যা তাজমহলকে একটি জীবন্ত শিল্পকর্মে পরিণত করেছে। এটি তাজমহলের নান্দনিক সৌন্দর্যকে আরও জাদুকরী করে তোলে।
প্রশ্ন: তাজমহল রাতে খোলা হয় কি?
উত্তর: সাধারণভাবে তাজমহল রাতের বেলায় খোলা থাকে না। তবে পূর্ণিমার আগের দিন, পূর্ণিমা এবং পরের তিন দিন, এই মোট পাঁচ রাতে সীমিত সময়ের জন্য দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে, যাকে বলা হয় “নাইট ভিউয়িং”। এই সময় বিশেষ টিকিটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শনার্থী তাজমহলকে চাঁদের আলোয় উপভোগ করার সুযোগ পান।
Feriwala এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
0 Comments